বিসিএসের প্রশ্নপত্রে মুক্তিযুদ্ধ হলো ‘প্রতিরোধ যুদ্ধ’

বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে মুক্তিযুদ্ধকে ‘প্রতিরোধ যুদ্ধ’ এবং পাকিস্তানি বাহিনীর পরিবর্তে ‘দখলদার বাহিনী’ লেখা নিয়ে নানা পরিসরে সমালোচনা চলছে।

বুধবার ৪৭তম বিসিএসের ‘বাংলাদেশ বিষয়াবলি’ বিষয়ের প্রশ্নপত্রে এসব শব্দ ব্যবহার করা হয়।

৪ ঘণ্টার ২০০ নম্বরের এ পরীক্ষার ‘মহানন্দা’ সেটের ‘১’ নম্বর প্রশ্নে বলা হয়েছে, “১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিন।”

বৃহস্পতিবার বিকালে একাধিক প্রার্থী ‘বাংলাদেশ বিষয়াবলি’ বিষয়ের পরীক্ষায় এমন প্রশ্ন থাকার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে স্বীকার করেছেন, তবে কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি।

ঢাকার একজন প্রার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিরোধ যুদ্ধ ও দখলদার বাহিনী শব্দগুলো দেখে কিছুটা খটকা লেগেছে। বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষার্থীরাও আলোচনা করেছেন।”

গত ২৭ নভেম্বর ৪৭তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শুরু হয়। ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে আবশ্যিক বিষয়ের পরীক্ষা। ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত পদ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের লিখিত পরীক্ষা হওয়ার কথা আছে।

শব্দ চয়ন নিয়ে সমালোচনা

এ ধরনের শব্দ চয়নের সমালোচনা করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক আসিফ বিন আলী বৃহস্পতিবার তার ফেইসবুক পেইজে লেখেন, “সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধ না লিখে লিখছেন ‘প্রতিরোধ যুদ্ধ’, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর না লিখে লিখছেন ‘দখলদার বাহিনী’।

“ডাকসুর এক নারী নেত্রী লিখছেন ‘সহস্রাধিক শহীদ’। জামায়াতের মুফতি কাজী ইব্রাহিম বলছেন, ১৬ ডিসেম্বর নাকি বিজয় দিবস না, তা ‘কালো দিবস’। বলছেন ৩২ নম্বর নাকি মুক্তিযুদ্ধের অংশ না। বিহারি হত্যাকাণ্ড নিয়ে আপনার প্রাণ কাঁদে। উগ্র ডানপন্থি আরেক তরুণ বুদ্ধিজীবী এখন মুক্তিযোদ্ধাদের মব হিসেবে লিখছেন। শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বলা যাবে না। কয় দিন পরে বলবেন, জিয়া তো বাগী ছিল। সময়ের অপেক্ষা মাত্র।”

তিনি আরও লেখেন, “আমরা যতবার চাই মুক্তিযুদ্ধ পক্ষের আর বিপক্ষের এই বয়ান থেকে রাজনীতিকে বের করে বর্তমানের অধিকারের দাবিতে আনতে, ততবার তারা ফেরত নিয়ে যায় ওই বয়ানেই। যারা এই কাজ করছেন, তারা যে ইতিহাসের জন্য করছেন, কিংবা বিহারিদের প্রতি দরদ থেকে করছেন, তা কিন্তু নয়। আসল কথা, এরা এখন এদের মুখোশ খুলে ফেলছে। এরা ৫৪ বছর আগে পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারেননি, তাই বারবার মুক্তিযুদ্ধকে আক্রমণ করতে ব্যস্ত।”

এম শাহজালাল পারভেজ নামের একজন ফেইসবুক ব্যবহারকারী প্রশ্নের একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, “১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সকল শ্রেণির মানুষ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল। ২০২৫ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে দখলদার বাহিনী এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিরোধ যুদ্ধ বলে কেন প্রচার করা হচ্ছে? ভুলে যাবেন না নিজের জন্ম নিয়ে যদি প্রশ্ন তোলেন, তাহলে মানুষ আপনাকে বেজন্মা বলবে।”

সাবিবুল ইসলাম নামের আরেকজন প্রার্থী ফেইসবুকে লিখেছেন, “পিএসসি এখন জামাতিদের দখলে। তাই ৪৭তম বিসিএস এর প্রশ্ন…পাকিস্তানি বাহিনী হইয়া গেছে দখলদার বাহিনী…আর মুক্তিযুদ্ধ হইয়া গেছে প্রতিরোধ যুদ্ধ! দেখতে থাকি আমরা।”

‘এমন শব্দের ব্যবহার আমাদের পাকিস্তান প্রেমকেই স্পষ্ট করে’

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক ও গবেষক সালেক খোকন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দখলদার বলে তারা (পিএসসি) পাকিস্তান শব্দটিকে সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল কিনা, এটি বরং তাদের প্রশ্ন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশ তো পাকিস্তান থেকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, লাখো শহীদের রক্ত, ত্যাগ আর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বেই অর্জিত হয়েছে। সেই দেশের প্রশ্নপত্রে বরং এমন শব্দের ব্যবহার আমাদের পাকিস্তান প্রেমকেই স্পষ্ট করে।

“এটা স্বাধীনতার ইতিহাসকে এক ধরনের বিভ্রান্তি ফেলার চেষ্টা কিনা সেই সন্দেহটিও থেকে যায়। আগে আমরা ইতিহাসের অতিরঞ্জন করা দেখেছি। এখন দেখছি ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়া চেষ্টা। এটি দুঃখজনক।”

তিনি বলেন, “আর মার্চ-এপ্রিল যেহেতু উল্লেখ করেছে, সেই সময় পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম হত্যাযগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ যুদ্ধ তো হয়েছিল। সেই অর্থে প্রতিরোধ যুদ্ধ বলাটা ঠিকই আছে। কিন্তু যদি বলা হয় দখলদার, তাহলে আবার প্রতিরোধ আসল কীভাবে? আপনার ওপর আক্রমণ হলেই তো প্রতিরোধের প্রশ্ন আসবে।

“এখানে পাকিস্তান কর্তৃক বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞের ঘটনাটিও কৌশলে হালকা করে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে মনে করি, যা প্রত্যাশিত নয়। কেননা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সূর্যের মতো সত্য, এটি আমাদের শেকড়ের ইতিহাস। এটিকে বির্তকিত, বিকৃত ও বদলে ফেলার চেষ্টা আগেও হয়েছে, এখনও হয়তো হচ্ছে।”

যা বলছে কমিশন

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন-পিএসসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেমের সঙ্গে বৃহস্পতিবার টেলিফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

বৃহস্পতিবার বিকালে কমিশন সচিবালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) মাসুমা আফরীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপনার কোন জিজ্ঞাসা থাকলে লিখিতভাবে আবেদন করুন। আমি টেলিফোনে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।”

কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা এস এম মতিউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বিষয়ে কমিশন এখনও কোনো মন্তব্য করেনি।”

কমিশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বিসিএস পরীক্ষা প্রশ্ন প্রণয়ন প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মডারেটররা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন। তারপর সেগুলো চূড়ান্ত করেন বিষয় বিশেষজ্ঞরা।”

কমিশন সরাসরি প্রশ্ন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় দাবি করে এ কর্মকর্তা আরও বলেন, “শব্দচয়ন নিয়ে আপত্তি যদি কমিশনের দৃষ্টিগোচর হয়, তবে কমিশন সাধারণত পরবর্তী সময়ে প্রশ্ন প্রণয়নের ক্ষেত্রে মডারেটরদের সতর্ক করে দেন।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *